একজন সিরাত আব্বাস বদলে দিচ্ছেন সহস্র এতিমের জীবন
১৮ মার্চ ২০২৫, ০২:২৪ পিএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:১২ পিএম

একবার ভাবুন তো জীবনের যা কিছু সঞ্চয় ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসায় ধস নেমে আপনি নিঃস্ব। কি করবেন,কোথায় যাবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। নিজের এমন অসহায়ত্ব, এমন দুর্দিনে পাশে নেই কেউ। তখন একটি বাস্তবতা,হ্যাঁ একটি কঠিন পরিস্থিতি বদলে দিলো আপনার সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। নিমিষেই বদলে গেল আপনার জীবন দর্শন। বদলে গেলেন আপনি বদলে দিলেন শত শত শিশু-কিশোর এবং অসহায় মানুষের জীবন। বলছি কিওর পাকিস্তান ওয়েলফেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা সিরাত আব্বাসের কথা,বলছি একজন স্বপ্নবাজ মানুষের কথা, বলছি নিঃস্বতা থেকে উঠে এসে হাজার মানুষের দায়িত্ব নেওয়া একজন মুসলমানের কথা।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বসবাসকারী এই প্রবাসী পাকিস্তানি নাগরিকের সাথে মুঠোফোনে কথা হয় দৈনিক ইনকিলাব (অনলাইন) এর সাথে। সেখানে নিজের জীবনের বহুবিধ বিষয়ে কথা বলেন কিওর পাকিস্তান ওয়েলফেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা সিরাত আব্বাস। তার ভাষ্যে উঠে আসে জীবনের নানা রকম প্রতিকূলতার চিত্র।
তিনি পাকিস্তানের করাচিসহ বিভিন্ন শহরে গত ৯ বছর ধরে পণ্য ক্রয় করার এমন একটি পদ্ধতি চালু করেছেন যেখান থেকে যেকোন পণ্য আপনি বিনা পয়সার কিনতে পারবেন। কেননা তার সেই আশ্চর্য বাজারে হাসি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হয়।
সাইকেল,ব্যাগ,ল্যাপটপ সবকিছুই আপনি বিনামূল্যে পাবেন বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটির চাওয়া একটু হাসি। এমনকি চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে শিক্ষা বৃত্তি সবকিছুই পাবেন হাসির মাধ্যমে। প্রশ্ন জাগতে পারে সবকিছুই যদি বিনামূল্যে পাওয়া যায় তবে এর অর্থের যোগান হয় কি করে? সময়টা ২০০৮ সাল। নিজের একটি ফ্যাক্টরি চালাতেন সিরাত আব্বাস। সেখান থেকে হতো বড় অঙ্কের মুনাফা। আর তাতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই দিনাতিপাত করছিলেন সিরাত। কিন্তু হঠাৎ করেই করাচী শহরের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে শহরের মানুষগুলো। বোমা আতঙ্কে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে শহরের দোকানপাটগুলো। এমন ঘটনার ফলে সিরাতকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। ব্যবসায়ের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে,নিজের ফ্যাক্টরি বিক্রি করে মানুষকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
ফ্যাক্টরি বিক্রি করে মানুষের ঋণ পরিশোধ করেন ঠিকই তবে নিজে টিকে থাকার মতো অবশিষ্ট আর কিছুই থাকে না সিরাতের। তখন তার উপলব্ধি হয় যে,যখন আপনার কিছুই থাকে না তখন পৃথিবী কতটা নিষ্ঠুর হয়ে যায়। আপন মানুষগুলোও দূরের হয়ে যায়। তখন তিনি এতিম-অসহায়, ছিন্নমূল মানুষগুলোর কথা ভেবে অশ্রুসিক্ত হন। সিরাত চিন্তা করেন যে আমার যদি এমন কষ্ট লাগে তবে শহরের এতিম, অসহায় ছেলে-মেয়েগুলোর কতটা কষ্ট হয় যখন ওর সমবয়সী একজন আরামসে দিনাতিপাত করতে অথচ একই বয়সে সেই শিশুটা একমুঠো খাবারের সন্ধানে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেমন লাগে সেই অসহায় পরিবারের যে পরিবারে বাবা টাকার জন্য তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে পারেনা। শুধু টাকার কাছে হেরে যায় শতশত তরুণের প্রাণ। এই চিন্তাই বদলে দেয় সিরাতের জীবনবোধ। মানুষ যখন নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত তখন তিনি এতিম ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য কাজ শুরু করেন।
অর্থ ছিল না তার তবে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে,এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে হবে নিজেকে কিছু একটা তৈরি করতে হবে তবে নিজের জন্য নয় বরং ঐ অসহায় মানুষগুলোর জন্য,তাদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। কথায় আছে যদি নিয়ত স্বচ্ছ হয় তবে সৃষ্টিকর্তাও সহায় হন। নিজের যা কিছু সম্পত্তি ছিল সবকিছু বিক্রি করে এবং কিছু অর্থ ঋণ করে সিরাত পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে ছিলনা কোন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন যারা আশ্রয়টুকু নিশ্চিত করতে পারে। বছরের পর বছর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে এমনকি ফ্যাক্টরির লেবারের কাজও করেন তিনি,এভাবেই নিজের স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছান সিরাত আব্বাস।
এরপর কিওর পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার নামে একটি ছোট পরিসরের এনজিও পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। প্রথমে ছোট পরিসরে হলেও আজ সেই প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার এতিম,অসহায় শিশু-কিশোরদের অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদান করছে। অনেককে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে নামি-দামি স্কুল-কলেজে। এমনকি কেউ যদি মারাত্মক অসুস্থ হয় এবং চিকিৎসার টাকা না থাকে তবে তার পুরো চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় কিওর পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার। এছাড়া সিরাত প্রতিবছর পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে 'হাসির বাজার' নামে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ফ্রি শপিংমলের ব্যবস্থা করেন।
যেখানে ল্যাপটপ,সাইকেল,নানা রকম ব্যয়বহুল খাবার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, খেলনা,ঘড়ি,জুতা এমন কোন জিনিস নেই যা নেওয়া যায় না। এমনকি কেউ যদি অন্য কোথাও থেকে কিছু কিনতে চায় তবে তাদেরকে সেই পণ্য কেনার জন্য নগদ অর্থও প্রদান করা হয়। যেন এই অসহায় মানুষগুলো অনুভব করতে পারে এটা তার নিজস্ব অর্থ। যেন তারা নিজেদের মতো করে যা খুশি তাই নিতে পারে। একটি সমৃদ্ধ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যা যা কিনতে পারে তার সবই পাওয়া যায় ফ্রি শপিংমলে এছাড়া একটি এতিম বাচ্চা যা কখনই কিনতে পারতো না তার সবকিছুই আয়োজন করা হয় তাদের জন্য। এমনকি দিনভর এই আয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির খরচ হয় প্রায় এক কোটি টাকা।
ইনকিলাবের সাথে কথা প্রসঙ্গে সিরাত বলেন,আমি সত্যি বলতে পাকিস্তানের বিভিন্ন উন্নত স্কুল-কলেজগুলোর সাথে কথা বলে এই এতিম ছেলে-মেয়েদের সেখানে লেখাপড়া করার সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা করি। কেননা আমি মনে করি যখন আমি থাকবো না তখন যেন ওরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও তিনি বলেন, আমার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে জানিনা কতদিন বাঁচবো তাই আমি চাই আরও কিছু মানুষ তৈরি হোক যারা সমাজের এই পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর পাশে থাকবে।
সামনে কোন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চান এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমি দেশের অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তাদের চমৎকার কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চাই। বর্তমানে আমরা শিশুদের পাশাপাশি নারীদেরও চিকিৎসা সেবাসহ নানা রকম সেবা প্রদান করে থাকি আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। আমরা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনা। বরং তাদেরকে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।
ভবিষ্যতে যদি দেশের বাইরে কাজ করার সুযোগ হয় তবে কোন কোন দেশগুলোকে প্রাধান্য দিবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সিরাত জানান, ভবিষ্যত যদি দেশের বাইরে কাজ করার সুযোগ হয় তবে প্রথমেই আমি যাবো বাংলাদেশে। কেননা পৃথিবী অনেক এগিয়ে গিয়েছে কিন্তু আমরা এখনও সম্পর্ক উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছি। সময় এসেছে দুই দেশের আন্তঃসম্পর্ককে ইতিবাচক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। এছাড়া আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলোতেও কাজ করতে চাই। যদিও আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত খুবই উগ্রবাদী এবং দেশটির সাথে আমাদের বর্ডার নিয়ে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান তবে আমি সেখানেও কাজ করতে চাই। আমার কাজে কে মুসলিম কে হিন্দু এটার থেকে অসহায় এতিম শিশুগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমাদের মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কোন ক্যাটাগরি করেননি। তার কাছে এতিমদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম,বৌদ্ধ খ্রিস্টান বিভাজন ছিল না।
প্রসঙ্গত,এছাড়াও চলছে পবিত্র রমজান মাস। পুরো মাসজুড়ে ইফতার এবং সেহেরির আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। যেসকল মানুষ সময়মতো বাসায় পৌঁছাতে পারে না এবং যাদের বাসস্থান নেই তারা সবাই এখানে একত্রে ইফতার করে।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

আমরা চাই না আ. লীগ নির্বাচনে আসুক : দ্য ডিপ্লোম্যাটকে নাহিদ

তুলসীকে দিয়ে ভারতের অযাচিত ষড়যন্ত্রে উদ্বিগ্ন-ক্ষিপ্ত নেটিজেনরা

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান চার্চিলের নাতির

শেরপুর গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব, ক্ষতিপূরণই কি সমাধান?

ফাঁদ পেতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে ছুরিসহ দুই ছিনতাইকারী আটক

গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলা, নেতানিয়াহু বললেন "এটি কেবল শুরু"

মুঠোফোনে ছবি দেখে সাংবাদিক শাহজাহানের উপর দুর্বৃত্তদের হামলা

গাজার পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ জাতিসংঘের মহাসচিব, যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান

ঢাকাস্থ ফেনী ফোরাম এর উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল

মুমিনদের আত্মগঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য অনন্য সেরা মাস মাহে রমজান

মধ্য রাতে নিরাপত্তা কর্মীদের মাঝে সাহরি বিতরণ করলো ইবি ছাত্রদল

স্পেনের প্রথম ফুটবলার হিসেবে রোজা রেখে খেলবেন ইয়ামাল

হুতিদের আক্রমণ ইরানের হামলা হিসেবে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র: ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি

খিলক্ষেতে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার কিশোরকে ছিনিয়ে জনতার হামলা, আহত ছয় পুলিশ

গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় হামাস সরকারের শীর্ষ নেতা নিহত

গণঅধিকার পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কমিটি গঠন

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ তথ্য উপদেষ্টার

করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা করার দাবি

শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলামের ১৬৩ ব্যাংক হিসাবে ৬ কোটি টাকা অবরুদ্ধের নির্দেশ

যুক্তরাজ্য থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানিসহ ক্রয় কমিটিতে ৭ প্রস্তাব অনুমোদন